Home STORY অনুভূতি (শেষ পর্ব)
Home STORY অনুভূতি (শেষ পর্ব)

অনুভূতি (শেষ পর্ব)


 

#পর্ব-১১(শেষ পর্ব)


ব্যস্তময় শহর।প্রকৃতিতে যেন নেমে এসেছে বিষাদময় পূর্বাভাস।বাতাস গুলোও কেমন তেতো ঠেকছে।

এয়ারপোর্টে সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে।পিনপতন নিরবতা নয় তবে কোলাহলের মাত্রা খুবই কম।


টিকিটের যাবতীয় কাজগুলো শেষ করে ফিরে এলো সাদিফ।নাজিফা বেগম এখনো মিহুকে জাপটে ধরে ফোপাচ্ছেন।উপস্থিত সবার চোখই পানিতে পরিপূর্ণ।ইপসা,ফারিয়া,তার বড়মামি সবাই ই বারবার চোখ মোছার বৃথা চেষ্টা করছে।মিহুর কোনো ভাবান্তর নেই।সে কেমন যেন অনুভূতিহীন।উল্টো পাশ থেকে সাদিফকে ফিরে আসতে দেখে সে মুচকি হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,


-কাঁদছো কেনো মা?তোমার কি মনে হচ্ছে আমি মারা যাব?

নাজিফার কলিজা কেঁপে উঠলো।এত আদরের মেয়ে তার!যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়?প্রতিউওরে কিছু বলার আগেই সাদিফ এসে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,

-তোকে না বলেছি উল্টা পাল্টা প্যাঁচাল পারবি না?চুপ করে থাক।মা তুমি কান্না বন্ধ করো।আমাদের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে।যেতে হবে।


মামার কাছে যেয়ে লাগেজগুলা পরখ করে নেয়।সবার দৃষ্টির অগোচরে ক্ষীণ সরে ইপসাকে বলে,


-মায়ের খেয়াল রেখো।

ইপসা মাথা কাত করে।যতদিন ওরা ফিরছেনা ততদিন মিহুর মায়ের সাথেই থাকবে সে।


সাদিফ নিজের লাগেজটা একহাতে ধরে আরেকহাতে মিহুর হাতটা শক্ত করে ধরে সে।মিহু আরেকবার চারপাশটায় চোখ বুলায়।ঘন পল্লবে ঢাকা চোখগুলো দিয়ে বারদুয়েক পলক ফেলে অতি আকাঙক্ষিত ব্যক্তিটাকে খুঁজে।

কিন্তু নাহ্,যতদূর তার দৃষ্টি যায় ততটুকুতে নাই সে।আবারও চোখ বন্ধ করে সে।ভাবে খুললেই হয়তো দেখবে অভি তার সাথে দেখা করতে এসেছে।হয়তোবা শেষ দেখা।তবুও দেখা তো হোক।

হাতে টান পরতেই সম্ভিৎ ফিরে তার।সাদিফ তাকে হাঁটার জন্য ইশারা করছে।দীর্ঘ:শ্বাস ফেলে পা বাড়ালো সে।

চোখের মনি এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে বারংবার।চোখের কোঁণে জমা হচ্ছে অভিমানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিক্ত কণা।

তাহলে কি অভি তাকে শুধুই বন্ধুর বোন মনে করে?আর কিছুইনা?তার অসুস্থতার কথা শুনে একটিবারের জন্যও কি তার সাথে দেখা করা যেতো না?নাকি উনি আমার অসুস্থতার কথা জানেই না?পরক্ষনেই ভাবে,নাহ,ভাইয়া অবশ্যই তাকে বলেছে।হয়তো উনিই প্রয়োজনবোধ করেনি অথবা তার ইচ্ছাই হয়নি দেখা করার।

এই একসপ্তাহে নিজের মনকে শক্ত করেছে মিহু।পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকাটাই যে কতটা সুখের সেটা ক্ষনে ক্ষনে বিস্তরভাবে উপলদ্ধি করতে শিখেছে।যদিও বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে থাকত সে।মূলত ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো তাকে।যেন মাথায় চাপ না পরে।

বড়মামা,সাদিফ আর সে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়।তার বাবা দেশে আসতে চেয়েছিলো তবে ভিসা পায়নি তাই আসা সম্ভব হয়নি।মিহু মুখ ঘুরিয়ে পিছে তাকায়।তার অতি প্রিয় মানুষগুলোর ছলছল নয়নের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে।জানে না আবার আসতে পারবে নাকি দেশে,দেখতে পারবে নাকি প্রিয় মানুষগুলোকে।


প্লেনে উঠার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সে ভেবেছিলো অভি সাথে হয়তো দেখাটা হবে।কিন্তু নাহ্!!আসলেই দেখাটা হলোনা!!সিটে মাথা এলিয়ে দিলো মিহু।চোখ বন্ধ করে মনে করলো সেদিন অভির মায়ের জন্মদিনের দিন তাদের শেষ দেখার হওয়ার সময়টা।চোখের কোঁণ ঘেঁষে দু ফোটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পরলো।

সাদিফ তাকে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,


-মাথা ব্যাথা করছে তোর?ওষুধ নিয়েছিলি না?


মিহু সন্তর্পণে পানিটা মুছে মৃদু হেসে বললো,


-ব্যাথা করছেনা ভাইয়া।তুমি চিন্তা করোনা।


সাদিফের চোখেমুখে বিস্ময়।এই এক সপ্তাহে মিহুকে একবারও কাঁদতে দেখেনি সে।কোথাও হালকা কেটে গেলেও বাড়িঘর মাথায় তুলে বসতো মিহু।আজ পর্যন্ত মাকে ছেড়ে একা কোথাও বেড়াতে পর্যন্ত যায়নি।অথচ আজকে...এই নির্ভীক মিহুকে নতুন করে দেখছে সে।নিজের ছোট্ট বোনটাকে নতুন করে চিনছে।


___________

ঘন্টাখানেক পরে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হবে মিহুকে।সাদিফের কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে।বাবার সাথে কথা হয়েছে কিছুক্ষন আগে।বাবার কন্ঠ টা কেমন যেন ভেজা ভেজা শোনাচ্ছিল..বাবাকে কখনোই কাঁদতে দেখেনি মিহু।

চোখ না খুলেই একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,


-আমার খুব ভয় করছে ভাইয়া।

সাদিফ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-ভয় পাবি কেনো?কত রেয়ার কেস আছে জানিস,মানুষ বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করে বলে বেঁচে যায়।

মনের জোরটাই আসল।এই ভয় তোর বেঁচে থাকার ইচ্ছা টাকে গ্রাস করে ফেলবে বোন।মনে সাহস রাখ।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।


মিহু উওরে কিছু বলার আগেই কেবিনে কারও ঢোকার শব্দে মুখ তুলে তাকায়।সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যায় সে।মুখটা কিনচিত ফাঁক হয়ে যায়।একটু আওয়াজ করেই বলে উঠে,


-আপনিইইই?


অভি কাছে এগিয়ে যায়।সাদিফ উঠে ,"আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি"বলে বেরিয়ে যায়।

অভি যেয়ে মিহুর পাশ ঘেঁষে বসে।একহাত দিয়ে বাহু জড়িয়ে ধরে বলে,


-আমার মিহুপাখি ভয় পাচ্ছে কেন?

অভির মুখে "আমার মিহুপাখি"ডাক শুনে লজ্জারাঙা হয়ে যায় মিহু।সেগুলোকে পাশে রেখে দৃঢ় অভিমানি কন্ঠে বলে,


-আপনি আমাকে দেখতে আসেননি কেনো?আমাকে কি আপনার মনে পরে না?নাকি আমি আপনার কেউ নই?

এই সময়ও মিহুর ছেলেমানুষি কথা শুনে অবাক হয় সে।আবার খুশিও হয় এই ভেবে যে মিহুর নার্ভাসনেসটা একটু হলেও কমেছে।


অভি কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলে,

-আমি রোজ তোমাকে দেখতে আসতাম।তুমি ঘুমিয়ে থাকতে বিধায় আমাদের দেখা হতোনা।আর শোনো,তুমি আমার মনেই থাকো তাই আর মনে করার দরকার পরে না।আর কি যেন বললে,তুমি আমার কেউ না?তুমিই তো আমার সব।আলাদা করে বলতে হবে মিহুপাখি?


মিহু মাথা নাড়ায় অর্থ্যাৎ "আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।সে বুঝতে পারছে"।


অভি মিহুর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে।একহাতের উল্টোপিঠে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে বলে,

-তোমাকে আমার জন্য হলেও বাঁচতে হবে মিহুপাখি।তোমায় ছাড়া আমি সত্যিই অপূর্ন।এই অপূর্ন আমার সঙ্গে পূর্নতা প্রাপ্তির পথটুকু চলার জন্যে হলেও আমার তোমাকে প্রয়োজন।একটু বেশিই প্রয়োজন মিহুপাখি।


মিহু মাথা নিচু করে রেখেছে।ভাবছে কেনো এই মুহূর্ত গুলো তার জীবনে আর একটু আগে এলোনা?এই অনুভূতিগুলো উপভোগ করার সময়টুকুও কি পাবে না সে?

হঠাৎই বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙক্ষা জেগে উঠলো মিহুর হৃদয়ে।হ্যাঁ,তাকে বাঁচতেই হবে।


খানিক পরেই নার্স এলো।মিহুর পোশাক বদলে অপারেশনের পোশাক পরিয়ে দেয়ার জন্য।

তারপর অপারেশন শুরু হলো। কিন্তু মিহুর আর সেখান থেকে ফেরা হলো না!


সমাপ্ত 

Comments

You May Also Like